বিজ্ঞাপন দিন

প্রকাশিত হয়েছেঃ জুলাই ১, ২০২৩ সময়ঃ ৫:০২ অপরাহ্ণ

আসাদুজ্জামান ভালুকা (ময়মনসিংহ)।।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার কথা। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে সুতা বাণিজ্যের গদিসামলাতেন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এম সোলায়মান।একদিন খুব ভোরে টানবাজারে গিয়ে দেখেন গদিতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন একজন সুতারএজেন্ট। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুতা সরবরাহের কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলে প্রায়ইএভাবে ঘুমাতেন তিনি। সেই ব্যক্তি এখন দেশের সর্ববৃহৎ সুতা উৎপাদনকারী কারখানার প্রধানকর্ণধার।

শূন্য থেকে বড় উত্থানের গল্প বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালকমো. বাদশা মিয়ার।  টানবাজারে সুতার গদি থেকেই ব্যবসার শুরু তার। ছিলেন স্পিনিং মিলেরএজেন্ট। সাধারণত স্পিনিং মিলের সঙ্গে বার্ষিক, দ্বিবার্ষিক বা ত্রিবার্ষিক চুক্তি করতেন। চুক্তিমোতাবেক স্পিনিং মিলের উৎপাদিত সুতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সুতার ব্যবসায়ীদের সরবরাহকরতেন। সেই সুতার গদি থেকেই এখন তিনি টেক্সটাইল খাতেরবাদশাহ বাংলাদেশটেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসাব মতে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকেডিসেম্বর পর্যন্ত দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সুতা রফতানি করেছে এমন শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যেপ্রথম অবস্থানে আছে বাদশা টেক্সটাইলস লিমিটেড। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্কয়ারটেক্সটাইলস লিমিটেড। তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি হলো কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানও বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের। ২০২০ সালেও শীর্ষত্ব ধরে রেখেছে বাদশা গ্রুপ অবইন্ডাস্ট্রিজ। ওই বছর সুতার রফতানিতে এক নম্বর অবস্থানে ছিল বাদশা টেক্সটাইল। দ্বিতীয়অবস্থানে ছিল কামাল ইয়ার্ন আর তৃতীয় অবস্থানে ছিল স্কয়ার টেক্সটাইল।

মাদারীপুর জেলার শিবচরের পাঁচচর ইউনিয়নে জন্ম মো. বাদশা মিয়ার। শিবচরে বসবাস করাজনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই তাঁত ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। সেই সূত্রে ১৯৭৬ সালের দিকেজীবিকার তাগিদে নারায়ণগঞ্জে আসেন বাদশা মিয়া। ১৯৭৭ সালে সুতার পাইকারি বাণিজ্যশুরু করেন। পর্যায়ক্রমে ঐতিহ্যগত সুতার গদির মালিক হন। সুতার বাণিজ্য দিয়ে ব্যবসা শুরুকরলেও শিল্প গড়ে তুলতে গিয়ে প্রথমে স্থাপন করেন রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা।২০০০ সালে গড়ে তোলেন পাইওনিয়ার সোয়েটার লিমিটেড। এরপর ২০০৪ সালে ময়মনসিংহেরভালুকায় একে একে স্থাপন করেন বাদশা টেক্সটাইলস লিমিটেড এবং কামাল ইয়ার্ন লিমিটেড।দেশে সুতা উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সামর্থ্য রয়েছে দুই কারখানারই। কারখানাগুলোরউৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক প্রায় ২৬৫ টন। বর্তমানে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের বার্ষিকটার্নওভার ৩০ থেকে ৪০ কোটি ডলার।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ করে দেশেরঅন্যতম বড় একটি শিল্প গ্রুপ। তাদের টেক্সটাইল কারখানায় উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রতিটিধাপে উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন বাদশা মিয়া। একাডেমিক শিক্ষাদীক্ষায় অতটা এগোতে নাপারলেও দেশের বস্ত্র খাত থেকে শুরু করে ব্যবসার হিসাবনিকাশে তার প্রজ্ঞা জ্ঞান অনেকপেশাদারের চেয়েও বেশি।

এত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার পরও ব্যবসাবাণিজ্যের প্রতি নিষ্ঠা একাগ্রতা এখনো ধরেরেখেছেন বাদশা মিয়া। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটির সময় প্রায় এক মাস বন্ধ ছিলশিল্প গ্রুপ বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। পরে উৎপাদন চালু হলে মো. বাদশা মিয়া ওই সময় টানা২০২২ দিন কারখানাতেই পড়ে ছিলেন। লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক মহামারীতে সংকটে পড়াশিল্পোৎপাদনের গতি পুনরুদ্ধার।

কর্মী ব্যবস্থাপনা উৎপাদন মসৃণ রাখার স্বার্থে বাদশা মিয়ার কারখানায় পড়ে থাকার ঘটনাশুধু কভিডকালে নয়। এর আগেও আরো অনেকবার এমনটি ঘটিয়েছেন তিনি। বাদশাগ্রুপসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজের প্রতি একাগ্রতা থেকেই নানা সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ীকারখানায় অবস্থান করেন বাদশা মিয়া। আর ব্যবসাবাণিজ্যের শুরু থেকেই চর্চা অব্যাহতরেখে চলেছেন তিনি। আর সে কারণেই টানবাজারের সুতার গদির ব্যবসায়ী থেকে এখন দেশেরশীর্ষ সুতা উৎপাদনকারী কারখানার মালিক তিনি।

দেশের অন্যতম বৃহৎ কারখানার কর্ণধার হিসেবে কভিড সংকট কীভাবে মোকাবেলা করছেনজানতে চাইলে মো. বাদশা মিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, কভিডকালীন সাতআট মাসে অনেকলোকসান হয়েছে। তুলার দাম পড়ে যায় মার্চএপ্রিলে। তখন আমরা হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম।এরপর পোশাকের ক্রয়াদেশ ফিরতে শুরু করলে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। অবশ্য দামপাওয়া যাচ্ছিল না তখনো। পর্যায়ক্রমে কারখানার সব মজুদ পণ্য শেষ হয়ে যায়। কারণে পূর্ণসক্ষমতায় কারখানা সচল রাখা গেছে। আমাদের স্পিনিংয়ে স্পিন্ডল তিন লাখের ওপরে।

পাইওনিয়ার ডেনিম বাংলাদেশে বৃহত্তম ডেনিম উৎপাদনকারী কারখানা এমন তথ্য জানিয়েবাদশা মিয়া বলেন, আমি কামলা মানুষ, এখনো ক্ষেতে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদেরস্পিন্ডলপ্রতি উৎপাদন শুধু বাংলাদেশ না সমগ্র ভারতের চেয়েও বেশি। স্কয়ার টেক্সটাইল গড়েউঠেছে আমার হাতে। ধারাবাহিকভাবে গত পাঁচ বছর প্রথম দ্বিতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিওআমাদের। বাদশা টেক্সটাইলের উৎপাদন সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমাদের কর্মীসংখ্যা বর্তমানে ২৮ হাজার।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে পরিচিত প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতেসুতা কাপড়ের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আছে হাজার ২৩২টি। এছাড়া কাপড় প্রক্রিয়াজাত করারডায়িংপ্রিন্টিংফিনিশিং মিল আছে আরো ২৪৪টি। মিলগুলো দেশের রফতানিমুখী নিটপোশাক কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় সুতার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে। আররফতানিমুখী ওভেন পোশাক পণ্যের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে। শিল্পে মোট বিনিয়োগ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই বিনিয়োগের বড় অংশে অবদানরেখেছে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।

বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানা গড়ে তুলতে ব্যাংকের অর্থায়ন নেয়া হয়েছে। আর তানেয়া হয়েছে শুধু কারখানার মূলধনি যন্ত্র স্থাপনে। এছাড়া ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জোগানওনিশ্চিত করা হয় ব্যাংকের সহায়তায়। প্রতিষ্ঠানটিতে বড় বিনিয়োগ করেছে এমন ব্যাংকগুলোরমধ্যে আছে বহুজাতিক হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি) বাংলাদেশ, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং আলআরাফাহ্ ব্যাংক। শুরুর সময়টাবাণিজ্যের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবসা করা হলেও শিল্প গড়ে তুলতে মূলতসহযোগিতা নেয়া হয়েছে ব্যক্তি খাতের ব্যাংক থেকে।

বাদশা টেক্সটাইলের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, আমার জানা মতে সুতা উৎপাদনে দেশেআমাদের চেয়ে বড় উৎপাদন সক্ষমতার কোনো প্রতিষ্ঠান আর নেই। বাদশা মিয়ার অন্যতম গুণহলো সততা। আর ব্যক্তি হিসেবে এই বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে গিয়েই ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনায়তিনি একজন অকপট মানুষ। চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণেই তিনি টানবাজারে সুতার বাণিজ্যেরগদি থেকে এখন দেশের শীর্ষ সুতা উৎপাদনকারী শিল্পের কর্ণধার। গত তিন দশকে গড়ে ওঠাদেশের বড় স্পিনিং মিলগুলো স্থাপনেও ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

বাদশা মিয়া বর্তমানে তার চার সন্তানের মধ্যে দুই সন্তানকে সক্রিয়ভাবে ব্যবসায় পাশেপেয়েছেন। এর একজন বড় ছেলে কামাল উদ্দিন আহমেদ আরেকজন ছোট ছেলে মহিউদ্দিনআহমেদ।

বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বাবারআদর্শে আমরা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সহযোগিতা করছি। বাবার কাছ থেকে অনেক কিছুশিখছি। এর মধ্যে অন্যতম হলো কোনো কাজে লেগে থাকা আর পরিশ্রম। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতেও আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারব।

(সংগৃহিত)

প্রকাশক ও সম্পাদক

আসাদুজ্জামান (ফজলু)

হাউজ নং: ২০, ফ্ল্যাট নং: বি২, রোড নং: ০৭

সেকশন: ১২, উত্তরা, ঢাকা – ১২৩০

মোবাইল: ০১৭১৮-১৯২৬৮৫, ০১৭৬১-৫৮২৩৩৮

ইমেইল: contact@digontabarta.com