বিজ্ঞাপন দিন

প্রকাশিত হয়েছেঃ মার্চ ২০, ২০২২ সময়ঃ ১১:১৬ পূর্বাহ্ণ

এম এস মনির চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান।।

চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সড়কের ওপর পণ্যবাহী ও ভারী যানবাহনের চাপ কমাতে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণ করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। মূলত নগরের সড়কগুলোকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করতেই চার লেনেরে এ সড়কটি নির্মাণ করা হয়। পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি করে ১৬টি পাহাড় কেটে জরিমানা গুণেও কাঙ্ক্ষিত সুফল আনতে পারছে না সিডিএ! এই সড়ক ঘিরে একের পর এক আপত্তি, অঘটন ঘটেই চলছে। কখনো খাড়া পাহাড়গুলো সড়কে ধপ করে ধ্বসে পড়ছে; আবার এসব কারণে কখনো যান চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে মাসের পর মাস। তাছাড়া যে মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করতে ৩২০ কোটি টাকা খরচে সড়কটি নির্মাণ করা হলো সেই মহাসড়কের সংযুক্তিতেও চরম অঘটন ঘটছে। মূলত নকশা ও পরিকল্পনা ঘাটতির কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মত ট্রাফিক বিভাগ ও সড়ক বিশেষজ্ঞদের।
এতোসব আপত্তি অঘটনের পরও সিডিএর নতুন স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু টানেলমুখী যানবাহনগুলো অন্তত বায়োজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড দিয়েই চলাচল করবে। আর তাতে করে ৩২০ কোটি টাকা খরচের সড়কটির নির্মাণের যৌক্তিতা ফুটিয়ে তুলতে সম্মত হবে সংস্থাটি। সেই আশাতেও গুড়েঁবালি আর বাঁধে বিপত্তি। এখানেও সিডিএর এই সড়কটিতে ‘আপদ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। জরিমানাকারী সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি সেই পুরোনো মামলাতেই আটকে রেখেছে সিডিএকে। তবে সিডিএ বিশেষজ্ঞ মতামত সম্বলিত প্রতিবেদন দিলেও তাকে অসম্পূর্ণ মন্তব্য করে কর্ণপাতই করছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। ফলে দেশের প্রথম নির্মিতব্য টানেল, দীর্ঘ আউটার রিং রোড ও নগরের পণ্যবাহী যান চলাচলের চাপ কমানোর স্বপ্ন দেখিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি করে ৩২০ কোটি টাকা খরচে যে লিংক রোড নির্মাণ করলো সিডিএ; তার সুফল এখন অনেকটাই বিফলের পথে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এদিকে চট্টগ্রাম নগরের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সংযোগ স্থাপনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম নির্মিতব্য টানেলের নির্মাণ কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। শেষ সময়ে এসে টানেলের দুই পাড়ে যানজট নিরসনে নানা পরিকল্পনা এঁটেছে টানেল ও ট্রাফিক বিভাগ। তবে এতো সব পরিকল্পনার পরও সব সুফল ভেস্তে যেতে পারে পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার মুখে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডকে কেন্দ্র করে নতুন সৃষ্ট জটিলতায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা জটিলতায় সড়কটির কাজ শেষ করতে না পারায় আগের সমস্যাগুলোর সঙ্গে এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠছে কর্ণফুলী টানেল ব্যবহারের সুফল নিয়েও। কেননা আউটার রিং রোড ধরেই টানেলের ভেতর দিয়ে আনোয়ারা উঠবে সব যানবাহন।

তাছাড়া সাগরিকায় আউটার রিং রোডের সঙ্গে নগরের আরেকটি প্রধান সড়ককে সংযোগ করতে যে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে তা বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করলেও নগরে চলাচলকারী ভারী যানবাহনের চাপ কমবে না। তাছাড়া আন্তার্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে নির্মিতব্য সংযুক্ত এই ফ্লাইওভারটি যখন জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে খেলা চলবে তখন স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তার কারণে বন্ধ রাখতে হবে। তখন সব পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ পড়বে ওই বায়েজিদ লিং রোডের ওপরই। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিডিএর ঝামেলা না চুকলে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা টানেল, আউটার রিং রোড, বায়েজিদ লিং রোডের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কখনই সফল হবে না। এমনিতে বায়েজিদ লিংক রোডের ফৌজদারহাট অংশে ভুল নকশা ও পরিকল্পনার কারণে মহাসড়ক ও আউটার রিং রোডে যুক্ত হতে আগে থেকেই নানা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে।

সিডিএ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হবে কর্ণফুলী টানেলের কাজ। সেখানে যান চলাচল শুরু হলে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহনগুলোর বড় একটি অংশ বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড হয়ে ঢাকায় যাতায়াত শুরু করবে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা জটিলতায় বাকি থাকা অল্প কিছু কাজ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি সারাবছরই খাড়া পাহাড়গুলো ধপ করে ধ্বসে পড়ছে লিংক রোডে। এসব কারণে কখনো যান চলাচল বন্ধ রাখতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এমন অবস্থায় টানেল দিয়ে যান চলাচল শুরুর আগে যদি এসব সমস্যার সামাধান করা না যায় তাহলে বিপত্তিতে পড়বে যান চলাচল। বাধাগ্রস্থ হবে হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পগুলোর সমন্বিত সুফল।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন,‘পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার কারণে বায়েজিদ লিংক রোডে কাজ শেষ করতে পারছি না আমরা। তারা সেখানে কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে না। আরও তিন মাস আগে নতুন ড্রইং ডিজাইন সাবমিট করলেও তাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যায়নি।

এর আগে, বায়েজিদ লিংক রোডে নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ১৮টি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণভাবে কেটে ফেলার অভিযোগ তোলা হয় সিডিএ’র বিরুদ্ধে। পাহাড় কাটার দায়ে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল— আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন নিয়ে ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটে সিডিএ। ৪৫ ডিগ্রি অ্যাংগেলের বিপরীতে খাড়াভাবে (৯০ ডিগ্রি অ্যাংগেলে) পাহাড় কাটার কারণে চরম ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। গত দুয়েক বছর ধরে বর্ষা এলেই দেখা যাচ্ছে পাহাড় ধ্বসের চিত্র। গত বর্ষায় প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা এড়াতে বেশ কয়েক দফায় বন্ধ করেও দেওয়া হয় সড়কটিতে যান চলাচল।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি যে বরাবরই যৌক্তিক সেটা বোঝা যায় বায়েজিদ লিংক রোডের খাড়া পাহাড়গুলো দেখে। ওই এলাকার বাসিন্দারাও বলছেন, শীত, বর্ষা, গ্রীষ্ম সারাবছরই ধ্বসে যাচ্ছে বায়েজিদ লিংক রোড এলাকার বিভিন্ন পাহাড়।

তবে সিডিএ প্রকৌশলীরা বলছেন,‘পাহাড় কাটায় হঠাৎ মামলা করা হয়েছে, তার আগে একবারের জন্যও সতর্ক করা হয়নি তাদের। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের শুনানিতে তুলে ধরা হয়েছে।’

তবে বিবাদমান দু’টি পক্ষের বক্তব্য যাই হোক, বাস্তবতা বলছে— ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ধ্বস চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে এলাকাটিকে। পাশাপাশি সড়কে নির্মিত ৬টি ব্রিজের নীচ থেকে ভারী বৃষ্টিতে মাটি সরে যাওয়ার কারণে সেগুলোও হয়ে উঠে
ঝুঁকিপূর্ণ। গেল বছরের আগস্টে ৫ নম্বর ব্রিজের নীচ থেকে মাটি সরে গিয়ে প্রায় ১ ফুট দেবে গিয়েছিল। সে সময় এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সড়কটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উল্লেখ করে বেশ কয়েক দফায় বন্ধ রাখা হয় যান ও জন চলাচল।

সিডিএর প্রকৌশল বিভাগ থেকে জানা গেছে, এবার হিল কাটিং ম্যানেজমেন্ট (রিটেনিং ওয়াল, জিওম্যাশ) পদ্ধতি অনুসরণ করে বায়েজিদের ওমেন ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন আরও কয়েকটি পাহাড়ে রিটেনশন ওয়াল (প্রতিরক্ষা প্রাচীর) তৈরির কাজ করতে চায় সিডিএ। এ প্রসঙ্গে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সিভয়েসকে বলেন,‘সেখানে শিগগিরই কাজ করার অনুমতি না পেলে সামনের বর্ষায়ও পাহাড় ধ্বসের সম্ভাবনা আছে। এ পরিস্থিতিতে সড়কটি ফের বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরে কর্ণফুলী টানেল চালু হলে এ সড়কে চাপ বাড়বে। সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত।

টানেল হলেই বহদ্দারহাটের চাপ পড়বে বায়েজিদে:

চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়তে চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ করছে সরকার। শহরমুখী হয়ে টানেলে প্রবেশের ৫টি সড়ক পথ হলো পতেঙ্গা বিচ সড়ক, এয়ারপোর্ট সড়ক, কাঠগড় সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেওয়ে ও আউটার লিংক রোড। ৭ জানুয়ারি সরকারের তৃতীয় বর্ষপূতি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, ‘২০২২ সাল হবে বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। আগামী অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল।

সিডিএ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের যে গাড়িগুলো এখন বহদ্দারহাট হয়ে চলাচল করছে, টানেল হওয়ার পর সেগুলোর বড় একটি অংশ বায়েজিদ লিংক রোড হয়ে চলাচল শুরু করবে। কিন্তু পাহাড় ধ্বসের কারণে এখনও পর্যন্ত সড়কটি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবেই বিবেচিত। যাকে ঘিরে নগরের ওই অংশে টানেলের সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘বায়েজিদ সড়কে এখন যে গাড়ি দেখা যাচ্ছে সেটা মোট গাড়ির ৪০ থেকে ৬০ পার্সেন্ট। অর্থাৎ কর্ণফুলী টানেল হলে এখানে আরও ৪০ থেকে ৬০ পার্সেন্ট গাড়ি চলাচল বাড়বে। এ অবস্থায় কাজ এগুতে না পারলে এটার জবাবদিহিতা কে করবে?’এ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী পরিবেশ অধিদপ্তরকেই দোষলেন সেটাই স্পষ্ট। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর একদমই উন্নয়ন বিরোধী নয় সেটাও সত্য বলে মিলছে তাদের বক্তব্যে। তাদের সাফ কথা সামগ্রিক উন্নয়নে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিজেদের কঠোর অবস্থানের কোন বিকল্প নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুফিদুল আলম সিডিএ’র পাল্টা জবাবে  বলেন, ‘ওই অংশে চট্টগ্রাম মেট্রো ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে সিডিএ’র বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। এর মধ্যে সিডিএকে একটি রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিল। তারা তা দিলেও সেখানে তথ্য উপাত্তের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এসিল্যান্ড অফিস কি বলছে আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করছি। তাছাড়া তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন।

প্রকাশক ও সম্পাদক

আসাদুজ্জামান (ফজলু)

হাউজ নং: ২০, ফ্ল্যাট নং: বি২, রোড নং: ০৭

সেকশন: ১২, উত্তরা, ঢাকা – ১২৩০

মোবাইল: ০১৭১৮-১৯২৬৮৫, ০১৭৬১-৫৮২৩৩৮

ইমেইল: contact@digontabarta.com