বিজ্ঞাপন দিন

প্রকাশিত হয়েছেঃ মার্চ ১০, ২০২২ সময়ঃ ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

এম এস মনির চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান।।

সাকিয়া সুলতানা, রাজশ্রী বড়ুয়া মুমু ও সিফাত আল মনসুর। এই তিন নারীর বাড়িই চট্টগ্রামে। তিনজনের বয়সও কাছাকাছি। তাঁদের প্রত্যেকেরই জীবন গল্প আলাদা আলাদা। তবে জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার মন্ত্র তিনজরেই এক। তারা হেরে যাননি কেউই। কোনো বাধাই থেমে থাকেন নি তাঁরা। সব রকম পরিস্থিতিতে লড়ে গেছেন নিজেদের মেধা, সততা ও পরিশ্রম দিয়ে। সময়ের ব্যবধানে শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আজ তাঁরা স্বনির্ভর এবং সফল ব্যক্তিত্ব।
এই তিন নারী এখন অনেকের কাছে— অনুকরণীয়ও। তিনজনই সেবামূলক সংগঠন ‘লায়ন ক্লাব অব চিটাগাং তিলোত্তমা’র সদস্য। সেই সূত্রেই তিনজনের মধ্যে সখ্যতা। নিজেদের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁরা করে চলেছেন সেবামূলক কাজ। তাঁদের এই যাত্রাপথের গল্পের শুরুটা কেমন ছিল, সে বিষয়ে কথা হয় সিভয়েসের।

তাঁদেরই একজন সাকিয়া সুলতানা। ৪১ বছর বয়সী এই সাহসী নারী সমানতালে চালিয়ে নিচ্ছেন ঘর-সংসার, ব্যবসায়। এমনকি সেবামূলক কার্যক্রমও। যতটা সহজ করে তাঁর সফলতার গল্প বলা যায়— তাঁর শুরুর যাত্রাটা অতটা সহজ ছিল না। ১৯৯৬ সাল। এসএসসি পরীক্ষার পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় সাকিয়ার। এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়ার সময় কোলজুড়ে আসে বড় মেয়ে। সেসময় পড়াশোনায় একবছরের ব্যাঘাত ঘটে। তবে তাতেও থেমে থাকেনি সাকিয়া। তার সাত বছর পর স্নাতকোত্তর পরীক্ষার কয়েক মাস আগেই জন্ম দ্বিতীয় মেয়ের।
বিয়ের পর যৌথ পরিবারে থেকেই চুকিয়েছেন পড়াশোনার পাঠ। হাতের কাজ থেকে শুরু করে রান্নাবান্নাসহ এমন কোনো সৃজনশীল কাজ বাকি নেই যা সাকিয়া সুলতানার আয়ত্তে নেই। ঘর সংসার সামাল দিয়ে পড়াশোনা করায় শেষমেশ চাকরি আর করা হয়ে উঠেনি সাকিয়ার। এরপর তৃতীয় মেয়ের জন্ম। মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ততায় কেটে যায় আরও কয়েকটি বছর। শেষে ২০১৬ সালের শেষদিকে ভাবনায় আসে নিজে কিছু করার। সাকিয়ার চারুকলা নিয়ে পড়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। শেষ পর্যন্ত পড়তে না পারলেও ঝোক ছিল কেকের ওপর।

নানা দেশের কেক আর্টিস্টদের কাছে কেক নিয়ে টানা দুই বছর বিভিন্ন কোর্স করেছেন তিনি। মালয়েশিয়ার উইলটন ইনস্টিটিউট থেকে ‘উইলটন ইউ এস এ’র তিনটি কোর্স করেছেন। নামকরা কেক আর্টিস্ট কানাডার ‘রোসালিন চেঙ্গ’, অস্ট্রেলিয়ার  ‘সেরন উই’, ইউরোপের ‘কার্লা পুজ, ফ্লাওয়ার কিং ‘এলেন ডান’মালেশিয়ার ‘বিনি ফং’ও সর্বশেষ বিশ্বের সেরা পেস্ট্রি শেফ ‘আন্হানিও বাচুর’র কাছে তিনি কাজ শিখেছেন। তারপর ২০১৭ সালে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ‘আর্টসি কেকস’ নামে একটা পেইজ খুলেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরিচিতি।

ব্যবসায় করার প্রসঙ্গে সাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘যখন আমি অনলাইনে ব্যবসায় শুরু করি, সে সময় মানুষ হাসাহাসি করতো। শুরুতে প্রায় সবাই বলেছিল, অনলাইনে কিভাবে ব্যবসা হবে? তোমার থেকে কে কিনবে? কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। যে কাজ একবার শুরু করেছি সেই কাজের শেষ দেখে ছাড়ব। কখনো হাল ছাড়িনি আমি। কখনো কোন কাজ শুধু করার জন্য করতে চাইনি। মন দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। এই কাজের পেছনে আমাকে সার্বক্ষণিক উৎসাহ দিচ্ছেন বড় ভাই আর আর আমার স্বামী।

মেধা, সততা ও পরিশ্রম দিয়ে গত চার বছরে সাকিয়া সুলতানা বাড়িয়েছেন ব্যবসার পরিধি। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি সমানতালে দক্ষতার সাথে সামলান পারিবারিক ব্যবসাও। যে বয়সে বিয়ে হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্য সব নারীরা ঝরে পড়ে, ঠিক সেই বয়সে যৌথ পরিবারে থেকে তিনি সামলেছেন সবদিক। নতুন নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম কথা আমি নারী হিসেবে নিজেকে কখনো আলাদা করে চিহ্নিত করতে চাইনি। আমরা যে ত্যাগ করে এসেছি তা যেন বাকি নারীরা না করে। সে ভাবনা থেকে কিছু একটা করার চেষ্টা করেছি। আমি কখনো মনে করিনি একটা কাজ শুধু মেয়ে করবে বা ছেলে করবে৷ ইনকাম করলে ছেলেও করবে, মেয়েও করবে। ঘরের কাজ করলে ছেলেও করবে, মেয়েও করবে। অর্থাৎ দুজনকেই করা উচিত।

আরেক সাহসী নারী উদ্যোক্তা সাকিয়ার বান্ধবী রাজশ্রী বড়ুয়া মুমু। টানা ১৪ বছর ধরে সামালাচ্ছেন ‘গান্ধারা আর্ট প্রেস’ নামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। যদিও তা ছিল পারিবারিক ব্যবসায় কিন্তু হুট করে ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লেখাবেন তা হয়তো ভুলেও আঁচ করতে পারেন নি রাজশ্রী বড়ুয়া মুমু। সম্মান তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন হঠাৎ বাবা মারা যান। তিনবোনের মধ্যে রাজশ্রী মেজো। বড় বোনের আগ্রহ না থাকায় ১৪ বছর আগে বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায়ের হাল ধরেছিলেন ২১ বছর বয়সী রাজশ্রী। প্রথাগত নিয়ম ভেঙে আমদানি ও রপ্তানি ব্যাবসায়ী হয়ে উঠেছেন রাজশ্রী বড়ুয়া মুমু।

সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে মুমু বলেন, ‘বাবা চলে যাওয়ার পর যখন ব্যবসায়ের হাল ধরতে হলো, আমি তখন এসবের কিছুই জানতাম না। একেবারে কিছুই বুঝতাম না। শুধু কারখানার এ মাথা ও মাথা হেঁটেছি আর হেঁটেছি। প্রত্যেকের কাজ ঘুরে ঘুরে দেখতাম। প্রত্যেকে কেমন করে কাজ করে তা শুধু হেঁটে হেঁটে দেখেছি। সেই সময়টা কত মানুষের কটু কথা শুনেছি হিসাব নাই। আসলে আমার কখনও মনে হয়নি আমি পারবো না। বাড়ি, ব্যবসা একই সাথে মেনটেন করা আসলে চাট্টিখানি কথা না। কিন্তু আমি করেছি এবং এখনও করে চলেছি। এমনও অনেক দিন গেছে যে একদিকে রান্না করছি, একদিকে ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং করছি আবার ছোট বাচ্চাটা আমাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এতকিছুর পরেও কাজটা ছাড়িনি। একারণে এখন আমি অনেক মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছি। মূলত সেবা করার মানসিকতা থেকে বড় পরিসরে কাজ করতে চেয়েছি যার জন্য লায়ন্সে যুক্ত হওয়া।

তিনি আরও বলেন, ‘তরুণ নারীরা যারা উদ্যোক্তা হতে চান তাদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে অবশ্যই পড়াশোনা করতে হবে এবং সময়-জ্ঞান থাকতে হবে। আমি নিজে অনুভব করি, সময় চলে গেলে আর ফিরে পাওয়া সম্ভব না। সেইসাথে নিজের ভেতরে এগিয়ে যাওয়ার স্পিড থাকতে হবে।

‘করোনা আমার জীবনে এসেছিল নতুন একটি পরিচয় তৈরি করতে। করোনা না এলে হয়তো আমি উদ্যোক্তা হতে পারতাম না। এখন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে নিজেকে খুব ভালো লাগে। পরিবারও আমার এ কাজে প্রচুর উৎসাহ দেয়। বিশেষ করে আমার স্বামী। বাধা যে পাইনি তা নয়, এ কাজ করতে গিয়ে আশেপাশের মানুষ অনেক কটু কথা বলেছেন। তবে নিজের কাছের মানুষগুলো উৎসাহ দিয়েছেন বলে অন্যের কথা খুব একটা গায়ে মাখিনি।’— এভাবেই নিজের কথাগুলো বলছিলেন তরুণ নারী উদ্যোক্তা সিফাত আল মনসুর।

যিনি চিটাগাং ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। সেইসাথে তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের মান উন্নয়নে স্থানীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘ইজি শপ সিটিজি’ নামের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপের এডমিন। ১ লাখ ৪০ হাজার সদস্যের এই গ্রুপে উদ্যোক্তাদের ৮০ শতাংশই নারী।

অনলাইনে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পণ্য বিক্রির কৌশল শেখানোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম ‘ইজি শপ সিটিজি’। কোভিড ১৯ এর এই সংকটকালে ২০২০ সালে মার্চের শেষ দিকে এই গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়। মূলত ই কমার্স প্ল্যাটফর্ম উই গ্রুপ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিফাত আল মনসুর ইজি শপ সিটিজি নামে গ্রুপের যাত্রা শুরু করেন।

তিনি বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের যত রকমের সমস্যা রয়েছে সে সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা করে থাকি। এখানে পোস্ট দিতে কোনো টাকা লাগে না। বিক্রেতা পণ্য বিক্রি করলেও কোনো কমিশন দিতে হয় না। এই উদ্যোগের শুরুতে ফোকাস ছিল আমার ব্র্যান্ডিং, আমার নিজের পরিচিতি তৈরি করা নিয়ে। শুরুটা কখনোই কারোর জন্য সহজ হয় না। কাজ ছোট কিংবা বড় হোক সবাইকেই কাজটা নিয়ে ভীষণ সাধনা করে যেতে হয়। মেধা, শ্রম, বুদ্ধি এবং সততা দিয়ে এগোনোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কখনো কম্প্রোমাইজ করিনি। কাজটিকে নেশা হিসেবে নিয়েছি, প্যাশন হিসেবে দেখেছি। কাজ যেমনই হোক, নিজের কাজকে সম্মান প্রদর্শন করে চালিয়ে যেতে হবে। পরিশ্রম আর লেগে থাকাটা নির্ণয় করবে আপনার অবস্থান।

তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু না কিছু করেছি। আমার ১৯ বছর বয়সে বিয়ে হয়। যার কারণে ভিতরে একটা চাপা কষ্ট আছে। তবে হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। তবুও মনে হয় আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। শিক্ষকতায় থাকলে সমাজের একটি অংশের কাজ করতে পারব। কিন্তু এখন যে মাধ্যমে আছি তা ব্যবহার করে পিছিয়ে পড়া নারীদের ব্যবসায় এনে আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরও

অনেকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছি। নারীদের জন্য কাজ করার বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অনেক কিছু করতে পারি নি। তাই আমিও চাই নারীরা উদ্যোক্তা হোক। আলহামদুলিল্লাহ এখানে অনেক নারীরা লার্নিং নিয়ে নিজেদের মত করে ব্যবসায় শুরু করেছে। যা আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি।

তিনি আরও বলেন, ‘নারীরা দুর্বার, তারা ঘর সামলাতে জানে বাইরে ও জানে। আমি বলব যার যে প্রতিভা আছে তার সঠিক প্রয়োগ করা উচিত। পেছন থেকে অনেক বাধা আসবে, তবে সেই বাধাকে কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রকাশক ও সম্পাদক

আসাদুজ্জামান (ফজলু)

হাউজ নং: ২০, ফ্ল্যাট নং: বি২, রোড নং: ০৭

সেকশন: ১২, উত্তরা, ঢাকা – ১২৩০

মোবাইল: ০১৭১৮-১৯২৬৮৫, ০১৭৬১-৫৮২৩৩৮

ইমেইল: contact@digontabarta.com