প্রকাশিত হয়েছেঃ মার্চ ২, ২০২২ সময়ঃ ২:১৪ অপরাহ্ণ
চীনের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় কর্ণফুলী নদীতে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণের মাধ্যমে নদীর তলদেশ দিয়ে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গার সঙ্গে সংযোগ হচ্ছে আনোয়ারা উপজেলা। দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের কাজ শেষ হতে না হতেই কর্ণফুলী নদীতে আরও একটি টানেল নির্মাণের কথা ভাবছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ইতোমধ্যে চীনা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অনুমতি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবও দিয়েছে সিডিএ।
চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া যখন প্রতিযোগিতায় নেমেছে এমন সময়ে বিষয়টি সামনে আসলো। কোরিয়া চায় চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দিতে; অন্যদিকে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি কোম্পানি নিজেদের খরচেই চট্টগ্রামে মেট্রোরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ পুরো মেট্রোরেল প্রকল্পই বাস্তবায়ন করে দিতে। তবে বিনিময়ে পতেঙ্গা সমুদ্র উপকূল থেকে মিরসরাই ইকোনমিক জোন পর্যন্ত ৬০ বর্গ কিলোমিটার জায়গায় সাগর ভরাট করে স্মার্ট সিটি গড়তে চায়। বিষয়টি নিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিও রাজি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির জন্য পর্যন্ত পাঠিয়েছে। সেই চার চীনা কোম্পানিকে দিয়েই মেট্রোরেল, সাগরতীরে স্মার্ট সিটির সঙ্গে কর্ণফুলী নদীতে আরও একটি টানেল নির্মাণ করতে চাইছে সিডিএ।
জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান শামস বলেন, ‘মিরসরাই উপকূল থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো স্মার্ট সিটি গড়ার প্রস্তাব দিয়েছে তারাই চট্টগ্রাম সিটিতে নিজ খরচে মেট্রোরেল নির্মাণে আগ্রহী। সরকারের অনুমতি পেলে তারা পুরো সিটিতে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করবে। সেকারণে আমরা চাইছি কর্ণফুলী নদীতে আরেকটি টানেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে। ওয়ান সিটি টু টাউন হবে টানেল নির্মাণের পর। ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটির যোগাযোগ ও ট্রাফিক বাড়বে। সেকারণে আরেকটি টানেল নির্মাণ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, ‘চীনের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় সাড়ে তিন কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। এটি চট্টগ্রাম মহানগরের পতেঙ্গাকে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে আনোয়ারা উপজেলার সাথে সংযুক্ত করেছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা যাচাইকালে কর্ণফুলী নদীর তিনটি সাইটে জরিপ করা হয়েছিল। কর্ণফুলী সেতু থেকে নেভাল একাডেমি পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীতে করা জরিপটি অ্যালাইনমেন্ট-এ, অ্যালাইনমেন্ট-বি, এবং অ্যালাইনমেন্ট-সি নামে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। বর্তমান অ্যালাইনমেন্ট-সি-তে টানেল নির্মাণ হচ্ছে। সে হিসেবে অ্যালাইনমেন্ট-বি তে আরেকটি টানেল নির্মাণ করা যেতে পারে তবে সেটি সরকারের অনুমতি পেলে আবার সম্ভাব্যতা যাচাই হওয়ার পর চূড়ান্ত হবে।
কর্ণফুলী নদীতে আরেকটি টানেল নির্মাণ হবে কিনা সেটার সম্ভাব্য যাচাইয়ের বিষয়টি চলতি বছরেই নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী।
এদিকে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেলটি আগামী অক্টোবর মাসেই চালু করা হবে বলে গত ৭ জানুয়ারি সংসদে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমানে টানেলের দুটি টিউবের নির্মাণকাজ শেষে এখন ভায়াডাক্ট, অ্যাপ্রোচ সড়ক, টানেলের অভ্যন্তরে সড়ক নির্মাণ, পিচ ঢালাই, ইউটিলিটি সার্ভিস সংযোজন, তিনটি ক্রসিং প্যাসেজ সংযোজন করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এছাড়া শতভাগ ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করে সার্ভিস এরিয়া ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কাজ চলছে।
চট্টগ্রামের সাগর তীরে স্মার্ট সিটি গড়তে সংসদীয় কমিটির সায়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবে চীনের প্রস্তাব প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার করে সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি ওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারে এ টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে।
প্রায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার এ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক, যার সুদহার ২ শতাংশ। টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার হলেও মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেলের ব্যস ৩৫ ফুট ও উচ্চতা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউব থেকে অন্য টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব প্রায় ১২ মিটার। টানেল দুটির মধ্যপথে তিনটি কানেকটিং প্যাসেজ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জরুরি প্রয়োজন কিংবা অভ্যন্তরীণ সংস্কারকাজ চলাকালীন একটি টিউব থেকে অন্য টিউবে এসব প্যাসেজ দিয়ে যানবাহন/প্রকল্প কর্তৃপক্ষ চলাচল করতে পারবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এই টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চীনের সাংহাই সিটির মতো বন্দর নগর চট্টগ্রামে গড়ে উঠছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেই চট্টগ্রাম মহানগরের পাশাপাশি নদীর অপর তীরে আনোয়ারা-কর্ণফুলী এলাকায় গড়ে উঠবে আরও একটি নতুন শহর। নতুন এই শহরের অবকাঠামো একের পর এক নির্মিত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, টানেলকে ঘিরে বন্দরনগর চট্টগ্রামে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হবে। ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হচ্ছে। সংযোগ সড়ক ও টানেলের ভেতরের সড়ক হবে সর্বমোট ৪ লেনের। এর মধ্যে ওয়ান ওয়ে একটি টানেলে সড়ক থাকবে দুই লেনের।
একটি টিউবের সড়ক দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা অভিমুখী এবং অপর টিউব দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা অভিমুখী যানবাহন চলাচল করবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রতিটি টিউব চওড়া ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউব থেকে অপর টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব প্রায় ১২ মিটার। টানেলের প্রস্ত ৭০০ মিটার। এবং দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৪০০ মিটার।